বুধবার, ৩০ জুন, ২০২১

আইনের দৃষ্টিতে "বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ" ও আইনগত ব্যাখ্যা

rape with marriage
 

শুরুতেই একটি কল্পনিক ঘটনার মাধ্যমে "বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ" বোঝার চেষ্ট করি। ধরা যাক, লাইলির সাথে মজনুর বহুদিনের নিবিড় প্রেমের সম্পর্ক। তাদের এই সম্পর্ক চূড়ান্ত পরিণয়ের দিকে না গিয়ে হঠাৎ একদিন ভিন্ন পথে মোড় নিল। বিচ্ছেদ হল তাদের। এই বিচ্ছেদের বিপরীতে ক্ষুব্দ লাইলি মজনুকে দেখে নেয়ার হুমকি দিল। তদানুযায়ী, লাইলি তার নিকটস্থ থানায় মজনুর বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ ঠুকে দিল। ধর্ষণের অভিযোগটি এই মর্মে দায়ের করা হল যে— প্রেমিক মজনু বিশ্বাস ভেঙ্গেছে লাইলির, বিয়ের প্রলোভনে করেছে ধর্ষণ! বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণের অভিযোগটি দায়ের করা হল— নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এর ৯(১) ধারায়।

আলোচনার বিষয়বস্তু :
লাইলি ও মজনুর মধ্যকার বিরাজমান বিরোধের আইনগত নানান দিক নিয়েই আমাদের আজকের আলোচনা। মনে রাখতে হবে, বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণের বিষয়টি এখনো আমাদের দেশীয় আইনে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা নেই। এমনকি এই সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট কোনো আইনও নেই। সুতরাং, এই বিষয়টি সম্পর্কে সুস্পষ্ট এবং সুনির্দিষ্ট কোনো বিধিবিধান আপাতত নেই। পূর্বে গুটিকয়েক এ সংক্রান্ত অভিযোগ থানা বা আদালতে দায়ের করা হলেও, অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে ভবিষ্যতে উচ্চ আদালতকে এই বিষয়ে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা দেয়া লাগতে পারে। অথবা, বৃহত্তর স্বার্থে আইনও সংশোধন করা লাগতে পারে। তবে, ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের অধীনে দায়েরকৃত বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণের গুটিকয়েক মামলায় উচ্চ আদালত ইতোমধ্যে কয়েকটি সিদ্ধান্ত প্রদান করেছেন যার মাধ্যইে মূলত এই বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করতে হবে, যেহেতু এসংক্রান্ত সুস্পষ্ট কোনো বিধান এখনোবধি নেই। প্রক্ষান্তরে, যেহেতু এই বিষয়টি একটি বৈশ্বিক আলোচিত বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে, তাই আমরা দেখব দেশের বাইরের আদালতগুলো এসম্পর্কে কি বলে।

আইনি আলোচনা :
বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণের বিষয়টি নিয়ে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে যেতে হলে আমাদের শুরুতেই দেখতে হবে ধর্ষণের সংজ্ঞা। কারণ, এখানে ধর্ষণকে প্রধান অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, এবং ধর্ষণের ক্ষেত্রে অভিযোগকারীনির সম্মতি আদায় করা হয়েছে বিয়ের প্রলোভনে। অর্থাৎ, বিয়ের প্রলোভন এখানে সম্মতি আদায়ের ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক।

ধর্ষণের সংজ্ঞা :
দন্ডবিধি ১৮৬০ এর ৩৭৫ ধারায় ‘ধর্ষণ’কে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। এই ধারা অনুযায়ী পাঁচটি অবস্থায় যৌন সম্পর্ক স্থাপন করলে তা ধর্ষণ হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে –

১। নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে ;

২। নারীর সম্মতি ছাড়া ;

৩। মৃত্যু কিংবা জখমের ভয় দেখিয়ে নারীর সম্মতি নিয়ে ;

৪। নারীর সম্মতি নিয়েই, কিন্তু পুরুষটি জানে যে সে ঐ নারীর স্বামী নয় এবং ঐ নারীটি তাকে এমন একজন পুরুষ বলে ভুল করেছে যে পুরুষটির সাথে তার আইনসঙ্গতভাবে বিয়ে হয়েছে বা বিবাহিত বলে সে বিশ্বাস করে ;

৫। নারীর সম্মতিসহ বা সম্মতিছাড়া যদি সে-নারীর বয়স ১৪ বছরের কম হয়।

এখন, বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণের বিষয়টি বিশ্লেষণে দেখা যায়, সেখানে অভিযুক্ত ব্যক্তি বিয়ের প্রলোভনে নারীর সম্মতি আদায় করেছে যা ৩৭৫ ধারায় ধর্ষণের শর্তের অন্তভুক্ত না। ফলত, ৩৭৫ ধারায় প্রদত্ত সংজ্ঞার সরল বিশ্লেষণে স্পষ্টত যে, বিয়ের প্রলোভনে যৌন সম্পর্ক স্থাপন ধর্ষণ হিসেবে সংজ্ঞায়িত হবে না।

অন্যদিকে, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এর ২(ঙ) ধারায় বলা হয়েছে, “ধর্ষণ” অর্থ ধারা ৯ এর বিধান সাপেক্ষে, Penal Code, ১৮৬০ (Act XLV of ১৮৬০) এর Section ৩৭৫ এ সংজ্ঞায়িত “rape”;

অর্থাৎ, দণ্ডবিধি, ১৮৬০ এর ৩৭৫ ধারায় প্রদত্ত ধর্ষণের সংজ্ঞা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ :
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এর ৯(১) ধারায় বলা হয়েছে,

যদি কোন পুরুষ কোন নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন, তাহা হলে তিনি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন।

ব্যাখ্যা— যদি কোন পুরুষ বিবাহ বন্ধন ছাড়া ষোল বছরের অধিক বয়সের কোন নারীর সাথে তার সম্মতি ছাড়া বা ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারণামূলকভাবে তার সম্মতি আদায় করে অথবা ষোল বছরের কম বয়সের কোন নারীর সাথে তার সম্মতিসহ বা সম্মতি ছাড়া যৌন সঙ্গম করে তা হলে তিনি উক্ত নারীকে ধর্ষণ করেছেন বলে গণ্য হবে।

এই ধারাও সম্মতি নিয়ে দৈহিক সম্পর্ক হলে তা অপরাধ হিসেবে গন্য হবে না তবে বয়স হতে হবে ষোলো বছরের বেশি। তবে ব্যাখ্যা অংশের একটি বিষয় এখানে উল্লেখ্য, বলা হয়েছে— প্রতারণামূলকভাবে যদি সম্মতি আদায় করা হয়। বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণের অভিযোগ মূলত এই বিধানের বিপরীতে দায়ের করা হয়।

লক্ষ্য করার বিষয়, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এর ৯(১) ধারার ব্যাখ্যা অংশে বলা হয়েছে, প্রতারণার মাধ্যমে যদি ষোল বছরের অধিক কোনো নারীর সম্মতি আদায় করে যৌন সংঙ্গম করা হয় তা ধর্ষণ বলে গণ্য হবে। কিন্তু, আইনটির ২ ধারার সংজ্ঞায় ক-ঠ পর্যন্ত বা অন্য ধারাগুলোতেও প্রতারণার কোনো সংজ্ঞা প্রদান করা হয়নি। মূলত, আইনের এই দুর্বলতার কারণে আইনটির অপপ্রয়োগের সুযোগ যেমন সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি অনেকে আবার ন্যায় বিচার থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে।

তবে এক্ষেত্রে একটি প্রশ্ন মনে আসতেই পারে যে, বিয়ের প্রলোভনে সম্মতি আদায় কোনো বৈধ চুক্তি হতে পারে কিনা? সেক্ষেত্রে ধর্ষণ না হয়ে চুক্তিভংঙ্গের মামলা দায়েরের কোনো সুযোগ রয়েছে কিনা? আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে আপাতত না। কারণ, মুসলিম শরীয়াহ আইনের বিধানানুযায়ী, ভবিষ্যতে বিবাহের প্রতিশ্রুতি সংক্রান্ত কোনো মৌখিক চুক্তি অনুমোদিত না। উপরন্তু, বিবাহের চুক্তি সর্বদা লিখিত ও নিবন্ধিত হতে হবে। তথাপি, চুক্তি আইন ১৮৭২ এর ২(জ) ধারানুযায়ী, যেকোনো সম্মতি বা কোনো বিষয়ে কথা দিলেই তা চুক্তিতে রূপান্তর হয় না যতক্ষণ না পর্যন্ত সম্মতিটি আইন দ্বারা বলবৎযোগ্য হয়।

প্রক্ষান্তরে, বিয়ের প্রলোভনে সম্মতি আদায় প্রতারণা হতে পারে কিনা? যদি হয়, তবে সেক্ষেত্রে আইনে এটার আলাদা ব্যাখ্যা এবং আলাদা শাস্তির বিধান থাকা উচিত।

অন্যদিকে, দণ্ডবিধি ১৮৬০ এর ৪৯৩ ধারা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি যদি কোনো নারীকে প্রতারণামূলকভাবে আইনসম্মত বিবাহিত বলে বিশ্বাস করান, কিন্তু আদৌ ওই বিয়ে আইনসম্মতভাবে না হয় এবং ওই নারীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করেন, তবে অপরাধী সর্বোচ্চ ১০ বছর পর্যন্ত সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে ও অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবে। এই ধারাটি মূলত বিয়ে বলবৎ আছে বিশ্বাস করিয়ে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। অতএব, এই ধারায় বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে বা ভবিষ্যতে বিয়ে করার আশ্বাস দিয়ে দৈহিক সম্পর্ক করলে তা অপরাধ হবে না।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন